সরদার বংশের ইতিহাস

দ্বীন মোহাম্মদ

অষ্টদশ শতাব্দীর শেষের দিকে অর্থাৎ ১৭৯৩-৯৫ সালের কোনো এক সময় আমাদের রক্ত ধারার পরম পুরুষ দ্বীন মোহাম্মদ পাবনার জমিদারের নির্দেশে সাবেক পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ থেকে এখানে জোতদার হিসেবে এসে বসবাস শুরু করেন। তিনি অত্যন্ত ধর্মপরায়ন ছিলেন। তার চরিত্রে সৎ ও নিষ্ঠাবানের পরিচয় ছিল। তিনি সপরিবারে এখানে এসে বসবাস শুরু করেন। তখন এ গ্রামে কোনো জনবসতি ছিল না বলে উল্লেখ পাওয়া যায়। 

তিনি গাইবান্ধার তুলশিঘাটের বড় মহানন্দপুর গ্রামের আদি বাসিন্দা। তিনি জমিদারের প্রায় তিনশ একর জমির জোতদার হিসেবে এখানে আসেন। তিনি বেশিদিন জীবিত ছিলেন না। অল্প বয়সে (আনুমানিক ৪০-৪২) বছর বয়সেই মারা যান। এসময় তার জোতদারীর দায়িত্ব পড়ে তার ছেলে কিয়াম উদ্দিনের ওপর।

কিয়াম উদ্দিন সরদার

উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেই পিতার পরিত্যক্ত সবকিছুর দায় দায়িত্ব কিয়াম উদ্দিন দ্বায়িত্ব গ্রহণ করে অত্যন্ত সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে সেই দায়িত্ব পালন করেন। তার আমলেই প্রজাবসতী বৃদ্ধিসহ প্রজা সংখ্যা বেড়ে যায় এবং জমিদারের কাঙ্খিত খাজনা তিনি পরিশোধে তিনি সক্ষম হন। ফলে জমিদার তার উপর সন্তুষ্ট হয়ে তাকে সরদার উপাধিতে ভূষিত করেন। সেই থেকে তার রক্ত ধারায় সরদার বংশের পরিচয়ে চলে আসছে। কিয়াম উদ্দিন পিতার মতই ধর্ম পরায়ন হলেও তার চরিত্রে ধর্মে উদারতার পরিচয়ও মেলে। তিনি তার সন্তানদের আরবি, ফারসি শিক্ষা ছাড়াও ইংরেজি শিক্ষাও দিয়েছিলেন। তার ছেলে ছিল দুইজন- ১। ইমাম উদ্দিন, ২। আরব উদ্দিন। তার জীবনকাল বা মৃত্যু সম্পর্কে আর কিছু জানা যায় নি।

ইমাম উদ্দিন

গাইবান্ধা জেলা তখন ভবানীগঞ্জ মহুকুমা নামে খ্যাত ছিল। সিপাহী বিদ্রোহের সময় বিদ্রোহী সিপাহীদের উৎসাহদানে প্ররোচনা দানকারীদের মধ্যে বেসামরিক তৎকালীন রাজনৈতিক ব্যক্তি বর্গের মধ্যে আমাদের মহিয়ান পুরুষ ইমাম উদ্দিন সরদার একজন অন্যতম ব্যক্তি ছিলেন। সিপাহী বিদ্রোহ দমনের পর ইংরেজ গভর্নমেন্ট সিপাহী বিদ্রোহে উৎসাহ/ প্রোরচণ দানকারী বেসামরিক ব্যক্তিবর্গকে খুঁজতে থাকলে তিনি বেশ কিছুদিন ছদ্ম বেশে পালিয়ে থেকে নিজেকে আত্মরক্ষা করেন। তার সন্তানদের শিক্ষাজীবন এবং দেশের স্বাধীনতার উচ্চাকাঙ্খা থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় তিনি, সেই আমলের একজন সুশিক্ষিত ব্যক্তি ছিলেন। মৃত্যুকালে তিনি তিন সন্তান রেখে যান। তারা হলেন- ১। রহিম বকস সরদার, ২। আজিতুল্য সরদার, ৩। ইসলাম উদ্দিন সরদার

এর মধ্যে এই জীবনে রহিম বকস সরদারের কোনো রক্ত ধারা নেই কারণ তিনি অকালেই মৃত্যু বরণ করেন।

আজিতুল্যা সরদার

ইমাম উদ্দিন সরদারের রক্তধারায় আজিতুল্যা সরদার একজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। রাজনৈতিকভাবে তিনি পিতার মতই দেশপ্রেমিক ছিলেন। শিক্ষাগত যোগ্যতায় তিনি এনট্রান্স পাশ ছিলেন। কর্মজীবনে তিনি মোক্তারি করতেন। ১৮৮৫ সালে ভারতীয় জনগণ প্রথম কংগ্রেস দল গঠনের মাধ্যমে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হলে তিনি কংগ্রেসে যোগ দেন। পরে মুসলিম লীগ গঠিত হলে মুসলিম লীগে যোগ দেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি ভারতের মুসলিম জনগণের জন্য পৃথক স্বাধীন দেশের সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।

তিনি প্রথমে ভবানীগঞ্জ মহুকুমা পরে, পরিবর্তীত গাইবান্ধা মহুকুমার দেওয়ানী ও ফৌজদারী আদালতের একজন বিজ্ঞ ও প্রভাবশালী মোক্তার ছিলেন। তিনি গাইবান্ধা শহরের প্রাণকেন্দ্রেই বাসাবাড়ি প্রতিষ্ঠা করে স্থায়ী বাস করেন। তিনি ছিলেন আহমেদ উদ্দিনসহ সাত সন্তানের জনক। তার মৃত্যুকাল সম্পর্কে জানা যায় নি। 

আহমেদ উদ্দিন সরদার 

আহমেদ উদ্দিন সরদার পিতার মতোই শিক্ষিত ছিলেন। তবে তিনি ছিলেন পিতার দিক থেকে বড় ভাগ্য বিরম্বিত এক পুরুষ। তার  দুই মেয়ের নাম গেন্দুলী বিবি ও হামিদা বেগম।

ইসলাম উদ্দিন সরদার

তিনি ইমাম উদ্দিন সরদারের সর্ব কনিষ্ঠ সন্তান। শিক্ষাগত যোগ্যতায় তিনি নাইন পাশ ছিলেন। মেঝো ভাই আজিতুল্যা মোক্তারের প্রভাবে তিনিও ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। তার জীবঙ্কাল বেশি দীর্ঘ ছিল না। মাত্র ৩৫-৩৬ বছর বয়সে তিনি তিন সন্তান ১। আফজাল হোসেন, ২। খাতির হোসেন, ৩। কছিম উদ্দিনকে এতিম করে ইহজগতের মায়া ত্যাগ করেন। 

আফজাল হোসেন

আফজাল হোসেন অল্প বয়সে পৃতৃ বিয়োগ ঘটায় ছোটভাইদের দেখাশুনা করা ছাড়াও জ্যাঠা আজিতুল্যা মোক্তার সাহেবের বাসাবাড়ির ফাইফরমায়েশ ও দেওয়ানী দরবারী করতে গিয়ে মাইনর পাশের বেশি লেখাপড়া করতে পারেননি।

জ্যাঠার রাজনীতির তিনি একজন বলিষ্ঠ ও সক্রিয় কর্মী ছিলেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় তিনি একজন ইংরেজ কর্মচারীকে কৌশলে হত্যা করেন। যদিও প্রকাশ্য কোনো সাক্ষী ছিল না। এরপরেও তার নামে ওয়ারেন্ট হলে তিনি আসামের ধুবরীতে পালিয়ে আত্মগোপন করেন। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হলে দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ শান্ত হলে এবং জ্যাঠা আজিতুল্যা মোক্তারের আইনি তদবীরের জোড়ে তিনি আদালত থেকে অব্যাহতি পান এবং ১৯১৪ সালে বাড়ি ফিরে আসেন।


আফজাল হোসেন বাড়ি ফিরে আসার অল্প কিছুদিন পরেই জ্যাঠা আজিতুল্যা মোক্তাদের পরিবারে এক বিরাট কোন্দল সৃষ্টি হয়। তার আর কোনো মতেই থামানো সম্ভব হয়নি। সেই সময়ে আজিতুল্যার বার্ধক্য অবস্থা-বৃদ্ধ আজিতুল্যার স্ত্রী মারা যাওয়ায় কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়েই হোক বা বার্ধক্য জনিত মস্তিষ্ক অবস্থার কারণেই হোক, তিনি নিজস্ব প্রায় ৫০-৬০ বিঘা জোত জমির উত্তরাধিকারী স্বত্ত্ব থেকে ছেলেদের আইনগতভাবে বঞ্চিত করেন। তার ছেলেরা সবাই সুশিক্ষিত ছিলেন। তারা পিতার এই অবাঞ্চিত কার্যকলাপে ব্যথিত হয়ে জন্মভূমি গাইবান্ধার মায়া ত্যাগ করে ভারতের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েন। আজ অবধি তারা সবাই নিরুদ্দেশ রয়েছেন। তখন শুধু আহমেদ উদ্দিন দুটি মেয়েকে নিয়ে কোথাও যেতে না পেরে গ্রামের বাড়িতে চলে আসেন


আমি বিভিন্ন মুরব্বীর জনদের মুখের বানী থেকে লিখছি। আহমেদ উদ্দিন সরদারের বাকি ছয়জন চাই তাদের সবার নাম আমি দিতে পারলাম না। এখানে উল্লেখ্য, তাদের তিনজনের অবস্থান ঠিকানা হচ্ছে একজন আসাম ও একজন পশ্চিম দিনাজপুরের বালুর ঘাটে স্থায়ীভাবে বাস করছেন। বাকি তিনজনের কোনো অবস্থান জানা সম্ভব হয়নি। এখানে উল্লেখ্য আমাদেরই বংশধর কি গভীর মনোতাপ নিয়ে দেশ ছেড়েছেন, আপননের মায়া ত্যাগ করেছেন আর ফিরে আসেননি। একি ভোলা যায়? আল্লাহ পাক তাদের সবাইকে হেফাজত করুন। এই দোয়াই আজ আমাদের শেষ দোয়া সেই সঙ্গে কামনাও করছি কোন অছিলায় যদি তাদের সাথে আমাদের পরিবারের মিলন হতো, তবে প্রায় শত বছর পরে কি আনন্দই না আমাদের সবার চোখে মুখে ফুটে উঠতো।" লেখক।

Comments

  1. পুরো ইতিহাস জানতে পারলে ভাল লাগত।

    ReplyDelete
  2. পূর্বপুরুষদের হতিহাস.....!! পূর্বপুরুষদের এই তথ্যবহুল লেখনীর জন্য লেখককে ধন্যবাদ।
    আমি নিজেও সরদার বংশের....
    নাম- মোঃ ওয়াদিলুর রহমান সরদার
    (বগুড়া)

    ReplyDelete
  3. আমি নিজেও সরদার পরিবারের নাতনী। শুনেছি আমার দাদা আর তার ভাই নাকি আসাম থেকে এসেছে। ফুফুর মুখে শোনা। কারন আমার দাদা মারা যায় আমার বাবা যখন ছোট। আমি শহরে বড় হয়েছি নানু বাড়ি। আবার আমার বাবা মারা যায় আমার বয়স মাত্র আট মাস। চাচারা আমাকে এড়িয়ে চলেছে সবসময়। আমি সেটা বুঝতে পারতাম কেননা আমার বাবার সব সম্পতি তারা কি করেছে আমি আজও সেটা জানি ।। আমি সম্পতির আশাও করিনি আমি শুধু তাদের একটু ভালোবাসা চেয়েছিলাম সেটা হয়নি। তাই দুরে চলে এসেছি তাদের থেকে। ভালো থাকুক তারা। আমার বাবা শিক্ষিত ও খুব ভালো মানুষ ছিলেন। মায়ের মুখে শোনা। সবাই দোয়া করবেন আমার বাবার জন্য।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

সরদার বংশের ইতিহাস (১ম পর্ব)